Bengali Essay Writing / বাংলা প্রবন্ধ রচনা - ১ম পর্ব - EDUREJA

Latest News

Bengali Essay Writing / বাংলা প্রবন্ধ রচনা - ১ম পর্ব

প্রবন্ধ রচনা - ১ম পর্ব
লেখক ও সম্পাদনায়ঃ রেজাউল হক সরকার

জীবনী বিষয়ক
Download this Part


বিদ্রোহী কবি নজরুল / আমার প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম
ভূমিকাঃ “ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নি কো নজরুল।”—অন্নদাশঙ্কর রায়
বড়ো আক্ষেপ করে কবি অন্নদাশঙ্কর পঙক্তি কয়টি লিখেছেন। দেশভাগের বেদনা আর পাঁচজন বাঙালির মতো কবিকেও বিচলিত করেছিল। কিন্তু সব ভাগাভাগির উর্ধ্বে নজরুলকে স্থাপন করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন নজরুল বাঙালী কবি। সকল সাম্প্রদায়িক গন্ডির বাইরে তার স্থান। সত্যিই নজরুল আমাদের জাতিসত্তার প্রতীক। তাঁর কবিতা আর গান আজও কোটি কোটি বাঙালীর জীবনের মহামন্ত্র ধ্বনিরূপে অনুরণিত। এককথায়—“সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল।”
দারিদ্র্য নিপীড়িত শৈশবঃ জন্মলগ্নেই নজরুলের ভাগ্যভূমিতে রোপিত হয়েছিল দুর্বিষহ দারিদ্র্যের বীজ। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মে দীনদরিদ্র কাজি ফকির আহমেদের ঘরে বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের পর্ণকুটিরে অগ্নিশিশু নজরুলের জন্ম হয়। নজরুলের মায়ের নাম জাবেদা খাতুন। শৈশবে তাঁর নাম ছিল দুখু মিঞা। পিতা ছিলেন পরধর্ম সহিষ্ণু অথচ নিষ্ঠাবান মুসলমান।
     মাত্র নয় বছর বয়সে নজরুলের পিতৃবিয়োগ হয়। ফলে শৈশবের শিক্ষার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গাঁয়ের মক্তবের লেখাপড়া বাদ দিয়ে চুরুলিয়ার লেটো গানের দলে যোগ দেন এই সুকন্ঠী শিশু নজরুল। সমকালীন পরিবেশই তাঁকে দিয়েছিল দুঃখ জয়ের মহৎ উত্তরাধিকার। মেধা ছিল প্রখর কিন্তু সীমাহীন আর্থিক সংকটের পাহাড় তাঁর গতিপথে সৃষ্টি করেছিল দুস্থর বাঁধা। এই বাঁধাই সরস্বতীর সূচিসুভ্র অঙ্গন থেকে কঠিন সংগ্রামের রণভূমিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
জীবনের আর এক গতিপথঃ ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে, গঠিত হয়েছে সাত হাজার সৈনিক নিয়ে বাঙালি রেজিমেন্ট। নজরুলের চেতনায় তখন যৌবনের উন্মাদনা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামক একটি গল্প ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ ১৯১৯ সালেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয়। এই কবিতায় তিনি আত্মস্বরূপ উন্মাচন করে বলেছিলেন—
“বল বীর
    বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারই নতশির
    ঐ শিখর হিমাদ্রির।”
কবি জীবনের সূত্রপাতঃ নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। তারপরে একে একে প্রাকাশিত হয় ‘দোলনচাঁপা’ (১৯২৩), ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪), ‘ছায়ানট’ (১৯২৪) প্রভৃতি। শুধু কাব্যই নয় অসাধারণ সঙ্গীত রচনাতেও নজরুল আজও কিংবদন্তীর মতো বেঁচে রয়েছে। তাঁর গানে একদিকে যেমন স্বদেশ চেতনা আর মানবপ্রেম প্রচারিত হয়েছে, অন্যদিকে মানব জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষার দ্যোতক প্রেমের অমীয় ধারা প্রাণ প্লাবিত জোয়ারে বাঙালীর মর্মে সৃষ্টি করে অপূর্ব গীতিঝংকার।
সাহিত্যসম্ভারঃ নজরুলের আবির্ভাব পরাধীন ভারতে। আজীবন দরিদ্র নিপীড়িত কবির মধ্যে ছিল এক কঠিন সংগ্রামের স্পৃহা। তাঁর ওপর সাম্রাজ্যবাদী অপশাসন তাঁর চেতনায় বিপ্লবের অগ্নিসংযোগ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কালে এবং তার পরবর্তী ব্রিটিশ ভারতে তাঁর কবিতার উজ্জীবনী শক্তি সংগ্রামের বীজ বপন করে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সর্বহারা’, ‘ভাঙার গান’, ‘কামাল পাশা’, ‘সিন্ধুহিল্লোল’ প্রভৃতিতে তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সাম্যবাদী চেতনার আপসহীন সংগ্রামের ভাব প্রাকাশিত হয়েছে। ‘সাম্যবাদী’, ‘ফণীমনসা’ নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর সাহিত্য রচনার সংক্ষিপ্ত তালিকা এইরূপ— ছোটোগল্পঃ ‘ব্যাথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’; উপন্যাসঃ ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, নাটকঃ ‘আলেয়া’, ‘ঝিলিমিলি’; কবিতাঃ ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘বুলবুল’—গীতগ্রন্থ ইত্যাদি।
উপাধি ও সম্মানঃ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পান। স্বাধীনোত্তর কালে ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।
উপসংহারঃ ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে—“কবি নজরুল ইসলাম বাংলার তথা সমগ্র ভারতের আশা প্রদানকারী কবি। তিনি অনাগত কালের কবি।” নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে বাংলাদেশের লোকজীবন তাঁর যথার্থ স্বরূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তিনি চির বিদ্রোহী তরুণ প্রাণের বার্তাবাহক। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, থাকবে বাঙালি, ততদিন তিনি বাংলার ঘরে ঘরে চিরজাগরুক থাকবেন তাঁর কবিতায়, গানে।
     ১৯৭৬ সালের ২৯শে মে, আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে রোগ জর্জর কবি গভীর আক্ষেপ বুকে নিয়ে চির বিদায় গ্রহণ করেন।

--------- x ---------

স্বামী বিবেকানন্দ / বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ / বীরেশ্বর বিবেকানন্দ / বিবেকানন্দ ও যুবসমাজ / মানবপ্রেমী বিবেকানন্দ / স্বামী বিবেকানন্দ – ভারতাত্মার প্রতীক
ভূমিকাঃ If you want to know India read Vivekanand. (রবীন্দ্রনাথ)
মহান যে পুরুষ, তাকেই মহাপুরুষ বলা হয়। কিন্তু মানবতার প্রতীক বিবেকানন্দকে মহা পুরুষ না বলে মহা মহা পুরুষ বলা যেতে পারে। তাঁর সৎ চিন্তা, তাঁর মহৎ ঞ্জান, জাতির মেরুদন্ডকে সোজা রেখেছে। বিবেকানন্দ ছিলেন জাতির গৌরব, মানব সেবার জীবন্ত প্রতীক, যৌবনের মূর্ত প্রতীক। আসলে বিবেকানন্দই ছিলেন ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষই বিবেকানন্দ। সম্প্রতি সেই মহাপুরুষ সার্ধশতবর্ষের আলোকে আলোকিত হয়েছেন। সেই আলোর মালায় তাঁর কর্মজগৎ আলোময় হয়ে উঠুক।
জন্মঃ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারী কোলকাতার সিমলা পল্লির বিখ্যাত দত্ত পরিবারে বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত, মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। অন্নপ্রাশনের সময় তাঁর নাম রাখা হয় নরেন্দ্রনাথ। যদিও তাঁর মা তাঁকে বীরেশ্বর বা বিলে বলে ডাকতেন।
বাল্যকাল ও পড়াশুনাঃ বাল্যকালে নরেন্দ্রনাথ একদিকে যেমন ভীষণ দুষ্টু ছিলেন, তেমনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছিলেন। নরেনের লেখাপড়া শুরু হয় মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশনে। সেখান থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তারপর জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশনে থেকে এফ.এ. এবং বি.এ. পাস করেন।
শরীরচর্চা ও খেলাধুলাঃ শরীরচর্চা ও খেলাধুলার প্রতি নরেনের বেশ আগ্রহ ছিল। ক্রিকেট খেলায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। এছাড়া তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। সংগীতচর্চাতেও তাঁর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
ঈশ্বরচিন্তা ও শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণঃ খুব ছোটোবেলা থেকেই নরেনের মনে ধর্মভাব ছিল। শিবনাম শুনলেই তিনি ছোটবেলায় আনমনা হয়ে পড়তেন। পরবর্তীকালে ‘ঈশ্বর কে’?—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তিনি বাহ্মবন্ধু কেশবচন্দ্র সেনের কাছে যান। কিন্তু এই জটিল প্রশ্নের উত্তর তিনি তাঁর কাছে পাননি। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণের দেখা পেলেন; শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীতে তাঁর মন ভরে গেল। তিনি তাঁর মধ্যেই খুঁজে পেলেন এক নতুন জীবন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব তিনি জীবসেবার মাধ্যে খুঁজে পেলেন। তারপর একদিন নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে হয়ে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
শিকাগো মহাধর্ম সম্মেলনে যোগদানঃ ১৮৯৩ সালে বিশ্ব মহাধর্ম সম্মেলন আমেরিকার শিকাগো শহরে আয়োজিত হয়। সেখানে ডাক না পেয়েও ভারতের একমাত্র হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেকানন্দ সেখানে উপস্থিত হন। মাত্র পাঁচ মিনিটের বক্তব্যের প্রথমেই তিনি আমেরিকা বাসীদের ‘ভাই ও বোন’ বলে সম্বোধন করলে প্রবল হাততালিতে সেই সম্মেলন ফেটে পড়ে। তারপর তিনি হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানবধর্মের ছবি সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে তাঁর বক্তব্যের পরই ভারতবর্ষ বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদা পেতে শুরু করে।
সেবা ও দেশপ্রেমঃ স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থভাবেই বুঝেছিলেন যে, ভারতের মূল জাতীয় সমস্যা হল জনসাধারণের চরম দারিদ্র ও অশিক্ষা। তিনি প্রথমেই দারিদ্র ও অশিক্ষা দূর করার উপায় খুঁজতে লাগলেন। তাঁর এই মহৎ কাজে ভগিনী নিবেদিতা এগিয়ে এলেন। এর প্রথম পদক্ষেপ তিনি ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপন করেছিলেন। ধীরে ধীরে সারা দেশে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মকান্ড ছড়িয়ে দিলেন। মানব সেবাই শ্রেষ্ঠ সেবা, শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাই তিনি—“জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”—এই মহান বাণীকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিলেন।
সাহিত্যকীর্তিঃ স্বামী বিবেকানন্দের সাহিত্যে সেবাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও বক্তৃতাবলি হল রাজযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক প্রভৃতি।
যুবসমাজ ও বিবেকানন্দঃ দারিদ্রপীড়িত ভারতবর্ষকে স্বপ্নের ভারতবর্ষ গড়ে তোলার জন্য তিনি যুবশক্তির উপর বিশ্বাস করতেন। তিনি জাত পাত নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছিলেন। আর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব দিয়াছিলেন যুবশক্তির উপর। যুবশক্তিকে তিনি বলেছিলেন—“তোমারা দেশপ্রেমিক হও, জাতিকে প্রাণের সঙ্গে ভালোবাসো। তোমরা বড়ো কাজ করবার জন্য জন্মেছ।” তিনি চরিত্রবান যুবকদল গড়ে তুলতে চেয়েছলেন। তাঁর আশা ছিল ছাত্র ও যুবকরাই ভারতকে স্বপ্নের ভারতবর্ষ বানাতে পারবে। তিনি যুব সমাজকে যৌবনের প্রতীক বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি নিজের দেশ ও যুবসমাজ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন।
উপসংহারঃ এই আলোক সামান্য, জাতির মেরুদন্ড ভারত পথিক স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ৪ জুলাই পরলোকগমন করেন। “আমি ৪০ দেখব না”—এই কথা তিনি রেখেছিলেন। এই মহাপুরুষের অকালমৃত্যুতে ভারতবর্ষ যেন পিতৃহীন হয়ে পড়েছে। তাঁর বাণী শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্ববাসীকে দারুনভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি আক্ষরিক অর্থেই কর্মবীর ও ধর্মবীর ছিলেন। “যে ধর্ম গরীবের দুঃখ দূর করে না, মানুষকে দেবতা করে না, তা কি আবার ধর্ম?”—ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি আজও আমাদের ধর্মের উর্দ্ধে উঠতে সাহায্য করে। তাইতো তাঁকে শ্রদ্ধা ঞ্জাপন করে বলা হয়—
“বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ঞ্জানের আলোক শিখা,
ভারত আত্মার মূর্তপ্রতীক বিশ্বপ্রেমের দিব্য লিখা।”

--------- x ---------

নেতাজী সুভাষচন্দ্র / একজন আদর্শ জাতীয় বীর / প্রিয় নেতা নেতাজী / আদর্শ দেশপ্রেমিক নেতাজী / সংগ্রামী নেতাজী / দেশনেতা সংগ্রামী নেতাজী / আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ / তেইশে জানুয়ারি / স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহানপুরুষ
“ ‘জয় হিন্দ’ যার জীবনমন্ত্র, দেশসেবা যার কাম,
ভারত মাতার বীর সন্তান, নেতাজী তাহার নাম।”
ভূমিকাঃ বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণীর দ্বারা উদ্বুদ্ধ, যিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই ‘মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত’, যাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’র সব্যসাচীর বাস্তব রূপ, পরাধীন ভারতের গ্লানি দূর করার জন্য যে বীর দেশপ্রেমিক আক্ষরিক অর্থেই আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন তাঁর নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
জন্ম ও শিক্ষাঃ সুভাষচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, উড়িষ্যার তৎকালীন রাজধানী কটক শহরে। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু এবং মাতা প্রভাবতী দেবী।
     মেধাবী সুভাষচন্দ্রের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কটকের একটি মিশনারি স্কুলে। এখানে তিনি কিছুদিন পড়েই কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই ১৯১৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। এখানে শিক্ষাকালে তাঁর মধ্যে দেশাত্মবোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই কলেজের এক ইংরেজ শিক্ষক ওটেন সাহেব একদিন ভারতীয়দের প্রতি কটূক্তি করলে তিনি প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করেন। ফলস্বরূপ তিনি কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন। পরে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় স্কটিশ কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর অনার্স সহ বি.এ. পাশ করেন। এরপর আই.সি.এস. পরীক্ষা দেবার জন্য বিলাতে যান এবং ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ স্থান অধিকার করে আই.সি.এস. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।
স্বদেশের জন্য দীক্ষাঃ সেকালে আই.সি.এস. ছিল সবচেয়ে বড়ো এবং ‘স্বর্গীয়’ চাকরি। স্বদেশপ্রেম ও পরাধীনতার জ্বালা সুভাষের চিত্তে তখন এতই তীব্র যে, তিনি সেরা চাকুরিটি হাতের মুঠোয় পেয়েও ইংরেজদের ‘গোলামি’ বর্জন করবার সিদ্ধান্ত নেন। ইংরেজদের গোলামি করতে হবে বলে তিনি আই.সি.এস.-এর নিয়োগপত্র কুঁচিয়ে ছিড়ে ফেলেন। সেদিনের তারিখ ছিল ১৬ জুলাই, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ। এরপর তিনি গান্ধীজীর কাছে যান এবং দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। এইভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর দীক্ষা হল।
স্বদেশী আন্দোলনঃ নেতাজীর আগমনে স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ‘অসহযোগ আন্দোলন’ থেকে ‘ইংরেজ ভারতছাড়ো’ আন্দোলনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সর্বত্র নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশে তখন সবিশেষ সক্রিয় ছিল সহিংস বিপ্লববাদ, সেই বিপ্লবীরাও বিশেষভাবে আশ্রয় খুঁজে পেলেন সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বের ভেতর। ইংরেজ শাসক আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করল। কারামুক্তির পর তাঁকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক করা হয়। এই সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পরিচালিত ‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে তিনি পুনরায় কারারুদ্ধ হন।
কংগ্রেসের সভাপতিপদ প্রাপ্তি ও কংগ্রেস ত্যাগঃ পূর্ণ স্বাধীনতা সমর্থক সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে হরিপুরা ও ত্রিপুরাতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। ত্রিপুরাতে গান্ধীজীর বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর সভাপতি পদ প্রাপ্তি তাঁর আসাধারণ জনপ্রিয়তার পরিচয় দেয়। এখানে তাঁর চরমপন্থী চিন্তাধারার সঙ্গে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের তীব্র মতপার্থক্য হলে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন পথের সন্ধান করতে থাকেন।
ইউরোপ থেকে জাপানঃ নেতাজী ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করে জার্মানি চলে যান। সেখানে তিনি হিটলারের সাথে দেখা করেন এবং জাপানে চলে যান। রাসবিহারী বসুর আনুকূল্যে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর নেতৃত্ব পান সুভাষ। এবং এই সৈন্য নিয়ে মুক্তিবাহিনী তৈরি করে ভারতের পথে এগিয়ে এসে ইংরেজ সৈন্যদের পরাভূত করে ইম্ফল ও কোহিমায় ভারতের পতাকা ওড়ান। মুক্ত করেন আন্দামান ও নিকোবর দীপপুঞ্জ।
দুর্ঘটনাঃ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে জাপান ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়। ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় তিনি নতুন সাহায্যের আশায় জাপানের তাইহোকু বিমান বন্দর থেকে বিমানে চেপে মঞ্জুরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তারপর থেকে তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন তিনি ঐ বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু তত্ত্বে কেউ বিশ্বাস করে না।
নেতাজীর আদর্শঃ দেশের মুক্তির আপোসহীন সংগ্রামী দেশবাসীর প্রতি সীমাহীন সমব্যথী দেশের তরুণদের এক মূর্ত প্রেরণা স্বরূপ দেশবরেণ্য এই নেতাজী সমাজের সকলের কাছে আদর্শস্থল।
উপসংহারঃ আজও ভারতবাসী তাদের প্রিয় নেতাকে খুঁজে বেড়ায়। বুঝি বিশ্বাস হয়না তাঁর অন্তর্ধান। আজ বড়ো দুঃসময়, প্রকৃত নেতার বড়োই অভাব। জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে আছেন, তাঁর সমুন্নত আদর্শে আমাদের ভাবিত হতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে তাঁর চারিত্রিক মহত্বকে।

--------- x ---------

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর / পঁচিশে বৈশাখ
ভূমিকাঃ ভারত তথা বিশ্বের যিনি কবি-শ্রেষ্ঠ, কবিতা-গান-প্রবন্ধ-ছোটোগল্প-উপন্যাসের মধ্যদিয়ে যাঁর সৃষ্টি ভাবনা, চিন্তা ও সৃষ্টি-বৈচিত্র্যে এক বিশ্ব-বিস্ময়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ-দার্শনিক, মানব-জীবনের চিরন্তন সুখ-দুঃখ প্রকাশের যিনি শ্রেষ্ঠ আধার সেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নিত্য স্মৃতিচারণ, মনন ও নিদিধ্যাসন আমাদের একান্ত জাতীয় কর্তব্য।
জন্ম ও শিক্ষাঃ কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে ১৮৬১ সালের ৭ই মে (বাংলা ২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ সন) জন্মগ্রহণ করেন সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ও মহামনীষী রবীন্দ্রনাথ। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও মাতা সারদা দেবীর চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ শৈশবে ওরিয়েন্টাল মেশিনারি, নর্মালস্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে কিছুদিন পাঠ নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রকৃত শিক্ষা হয়েছিল পরিবারের পাঠশালায়। সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে লন্ডনে পাঠানো হয় ব্যারিস্টারি পড়তে, কিন্তু ব্যারিস্টারি পড়া তাঁর শেষ পর্যন্ত হয়নি।
সাহিত্য সাধনাঃ মাত্র তেরো বছর বয়সেই তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। ক্রমে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর অনবদ্য কাব্য রচনা—প্রভাতসংগীত, সন্ধ্যাসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, ভানুসিংহের পদাবলী, মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলী, গীতালি, গীতিমাল্য ইত্যাদি বিভিন্ন সৃষ্টি। শুধু কাব্য সাধনাই নয়—গল্প-উপন্যাস-নাটক, ব্যাঙ্গ-কৌতুক, হাস্যরসাত্মক নাটিকা, রম্যরচনা, রূপক-সাংকেতিক নাটক, প্রহসন, গান, প্রভৃতি সাহিত্যের প্রতি ক্ষেত্রে তিনি সার্থক পদচারণা করেছেন।
সংগীত, চিত্রাঙ্কন, অন্যান্য সৃষ্টিঃ রবীন্দ্রনাথের সংগীত সৃষ্টি তাঁর অনন্য প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিক। তাঁর সৃষ্ট প্রায় দ্বি-সহস্রাধিক সংগীত অনুভূতি, শিল্পিত বাণী ও অনুপম সুরের এক অনবদ্য ত্রিবেণী সংগম। অভিনয়, আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কনেও তাঁর অনন্য প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণাদাতাঃ তাঁর গানের মধ্যদিয়ে ভারতের জাতীয় আশা-আকাঙ্খা মূর্ত হয়ে উঠেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি ইংরেজদের দেওয়া ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন। তাঁর রচিত দুটি গান পৃথক দুটি দেশ ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আর নেই।
কর্মসাধনঃ বোলপুরের কাছে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা (১৯০১ খ্রি.) তাঁর কর্মজীবনের আর এক অনন্য কীর্তি, যা পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণতি লাভ করে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিঃ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যের ইংরেজী অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
মহাপ্রয়াণঃ অবশেষে সুদীর্ঘ, পরিপূর্ণ সার্থক জীবনের অন্তে বাংলা কাব্যের প্রথম রূপশিল্পী, মহামনীষী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট (বাংলা ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ) মহাপ্রয়াণ ঘটে।
উপসংহারঃ রবীন্দ্রনাথ যে কেবল নিছক একজন কবি ছিলেন, তা নয়—তিনি ছিলেন মনীষী। ছিলেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তাঁর দেড়শো বছরের জন্মবর্ষে তিনি আমাদের কাছে এখনও পথপ্রদর্শক। এক বিশাল বনস্পতির মতো তাঁর সুশীতল ছায়াতেই গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজোর মতো আমাদের চলতে থাকুক রবীন্দ্র অনুধ্যান, রবীন্দ্রচিন্তা, রবীন্দ্র গবেষণা, রবীন্দ্র আলোচনা—অনন্তকালব্যাপী।

--------- x ---------

মাদার টেরিজা / এক মাতৃরূপী মহীয়সী নারী / সকলের মা মাদার টেরিজা / মা টেরিজাকে আমরা ভুলি নি / করুণাময়ী লোকমাতা মা টেরিজা
“মা টেরিজা বিশ্বমাতা,
মূর্তিমতি করুণা,
সেবা যাহার জীবন ব্রত,
প্রেম ধর্মের সাধনা।”
ভূমিকাঃ আর্ত, পীড়িত, দীন-দরিদ্র অসহায় মানুষের সেবাই ঈশ্বরের সেবা। এই আদর্শকে সামনে রেখে যাঁরা আত্মোৎসর্গ করে ধন্য হয়েছেন, তাদের মধ্যে স্মরণীয় একজন হলেন বিংশ শতাব্দীর জননী—করুণাময়ী মাদার টেরিজা।
জন্ম ও শিক্ষাঃ টেরিজার জন্ম হয় যুগোস্লাভিয়ার স্কপিয়ে শহরে, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট। তাঁর পিতার নাম নিকোলাস বোজাশিউ। যিনি বাড়ী তৈরির ঠিকাদারের কাজ করতেন। মাতা ড্রান-ফিল বার্নাই। টেরিজার প্রকৃত নাম ছিল অ্যাগনেস গোনাশা বোজাশিউ।
টেরিজার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় সেক্রেড হার্ট চার্চে। এখানকার শিক্ষা শেষ করে রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ে পাঠ শুরু করেন সার্বো ক্রোয়েশিয় ভাষায়।
সেবার আহ্বানঃ সেবার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি ভারতে আসেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৮ বছর বয়সে এবং কলকাতাকেই তাঁর কর্মকেন্দ্র রূপে বেছে নেন। প্রথমে তিনি লরেটোর নবগতা কর্মীরূপে সেন্ট মার্গারিটা স্কুলের শিক্ষিকারূপে যোগদান করেন। ভগবান যীশুর কাছে তিনি প্রত্যাদেশ পান—“আমি এইখানে, এই আর্ত-ক্ষুধিতের ভীড়ে।” তখন থেকেই চাকুরি জীবনের ফাঁকে ফাঁকে মতিঝিল বস্তিতে তাঁর প্রকৃত সেবার কাজ শুরু হয়। মতিঝিল বস্তিতে একটি গাছের তলায় দু-তিনজন শিশুকে নিয়ে তাঁর স্কুল শুরু হয়। শিক্ষাদান ও সেবা এই দুটি ব্রত নিয়ে তাঁর সাধনজীবনের সূত্রপাত। সেই সঙ্গে দুঃখী মানুষের ‘মা’ হয়ে ওঠার তপস্যা।
মাদার হাউসঃ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পোপের অনুমতি নিয়ে তিনি ১৪ নং ক্রিক লেনের একটি ছোটো ঘরকে কেন্দ্র করে মানব সেবার কাজ পূর্ণোদ্যমে শুরু করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’লোয়ার সার্কুলার রোডে প্রতিষ্ঠা করেন চ্যারিটি নামক সংস্থা।
সেবা কেন্দ্রঃ প্রায় শূণ্য হাতে মাত্র ১০ জন সহযোগিনীকে নিয়ে মাদার সেবার কাজ শুরু করেছিলেন। মাদার হাউসের পাসেই গড়ে তোলেন ‘শিশুভবন’, পরিত্যক্ত, অনাথ শিশুরা আশ্রয় পায় সেখানে। কালীঘাটে প্রতিষ্ঠিত ‘নির্মল হৃদয়’ কুষ্ঠ রোগীদের পরম ঠাঁই। টিটাগড়, আসানসোল, দিল্লিতে গড়ে তোলেন কুষ্ঠ রোগীদের জন্য আশ্রম। ভারতের বাইরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, রাশিয়া, পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর সেবাকেন্দ্র। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে ৪৭০টির বেশি সেবা প্রতিষ্ঠান। ভাষাহীন মানুষের চেতনায় ঞ্জানের আলো দিতে গড়েছেন ১২৪টি স্কুল। রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ২২০টি দাতব্য চিকিৎসালয়।
সম্মান ও পুরস্কারঃ মাদার টেরিজা সারা জীবনে ‘ম্যাগসেসাই’, পোপের আছ থেকে ‘Good Samaritan Prize’, ‘কেনেডি আন্তর্জাতিক পুরস্কার’, ‘সোভিয়েত নেহরুল্যান্ড’, ‘ভারতরত্ন’ এবং ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে নোবেল শান্তি পুরস্কার-এর মতো আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি এইসব পুরস্কারের অর্থ খরচ করেছেন দরিদ্র আতুরদের জন্য।
জীবনাবসানঃ ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর ৮৭ বৎসর বয়সে মাদার টেরিসা খ্রিস্টলোকে প্রয়াণ করেন। তিনি আজ মাদের মাঝে না থাকলেও বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের বেদিতে তিনি আজও আসীন। কবির ভাষায় বলা যায়—
“নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।”
উপসংহারঃ সকল আতুর জনের পরম আশ্রয় ‘প্রাণের আশ্বাস, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’ সকলের মাতৃস্বরূপা মাদার টেরিজা আজ আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর উত্তরাধিকার হিসাবে আমাদের হৃদয়ে সমাজসেবার চিন্তা ও চেতনা জেগে উঠুক এই যেন আমাদের প্রার্থনা হয়। যেন সকল চিত্তে জাগরূক হয় সেই অমর বাণী—
“বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কোথায় আমার ঘর,
আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে কে মোর আত্মপর।”

--------- x ---------

নবজাগরণের এক মহান পুরুষ / এক আদর্শ পুরুষ / ঈশ্বরচন্দ্রের জীবন ও সাধনা / ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর / প্রিয় মনীষী বিদ্যাসাগর / ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার জনক বিদ্যাসাগর / বিদ্যাসাগর ও শিক্ষা আন্দোলন / একজন মহাপুরুষের জীবনী
The man has the genius wisdom of an ancient sage,
Energy of an Englishman, and the heart of a Bengali mother” (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
ভূমিকাঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে বাঙালী সমাজ যখন অশাস্ত্রীয় কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষার অচলায়নে আবদ্ধ, শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তথাকথিত সমাজপতিরা যখন দন্ডমুন্ডের কর্তা, মানুষের স্বাধীন মনুষ্যত্ব যখন পদে পদে লাঞ্ছিত, সেই তমসাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে যাঁদের অবদানে বাংলায় নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই প্রাণপুরুষ, সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন অগ্রগণ্য শ্রেষ্ঠ।
জন্ম ও শিক্ষাঃ মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম। পিতা ছিলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী। কালিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গ্রাম্য পাঠশালায় লেখাপড়া শেষ করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় এসে সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। দারিদ্র্যের কারণে তাঁকে রাতে রাস্তার গ্যাসের আলোয় পড়াশুনা করতে হয়েছে। মেধাবী ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র এখানে ১৮২৯ থেকে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যয়ন করে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর পান্ডিত্যের জন্য ‘হিন্দু-ল-কমিটি’ তাঁকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দান করেন।
কর্মজীবনঃ তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র ২১ বছর বয়সে বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুকালের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিতের পদ অলংকৃত করেন। পরে তিনি যোগ দেন সংস্কৃত কলেজে। আপন দক্ষতায় হন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। সেই সময় সংস্কৃত কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ ছাত্রদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। বিদ্যাসাগর প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করে দেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু স্বাধীনচেতা বিদ্যাসাগর কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় উভয় পদে ইস্তফা দেন। তখন তাঁর বেতন ছিল ৫০০ টাকা। শুরু হয় তাঁর বৃহত্তর কর্মজীবন। তিনি আত্মনিয়োজিত করেন সমাজসেবায়, শিক্ষাবিস্তারে, সাহিত্যসাধনায়, মানবকল্যানে।
সাহিত্যকীর্তিঃ বাংলা সাহিত্যে তখন দুর্দিন। বিদ্যাসগর অনুভব করেন বাংলা ভাষা বিস্তারে প্রয়োজন বাংলা গ্রন্থের। ১৮৪৭-১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪৪ বছরে বিদ্যাসাগর রচনা করেছেন বহু বাংলা গ্রন্থ। তার মধ্যে অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যাই সব থেকে বেশি। ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয় “বেতাল পঞ্চবিংশতি”। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে মহাকবি কালিদাসের গ্রন্থ অনুবাদ করে রচনা করেন শকুন্তলা। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ভবভূতির ‘উত্তরচরিত’ অনুবাদ করে রচনা করেন ‘সীতার বনবাস’। এছাড়াও তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে প্রধান ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯), ‘বোধোদয়’ (১৮৫১), সেক্সপীয়রের ‘কমেডি অব্‌ এররস্‌’-এর অনুবাদ করে রচনা করেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬৯)। তাঁর অসামান্য পান্ডিত্য তাঁর সাহিত্যে তিনি প্রকাশ করতে চাননি। অনুবাদ সাহিত্যে নিজেকে নিয়োজিত করে বাংলা সাহিত্যকে উন্নীত করেছিলেন। তাঁর মৌলিক রচনার সংখ্যাও কম নয়। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’। দুই খন্ডে রচনা করেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫)। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন প্রভাবতী সম্ভাষণ, দুই খন্ডে রচনা করেন ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ (১৮৭১ ও ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে ‘কথামালা’ (১৮৪৮), ‘চরিতাবলী’ (১৮৪৬), ‘আখ্যানমঞ্জুরী’ (১৮৬৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলা ভাষায় অবদানঃ ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক, বাংলা গদ্যের যথার্থ প্রথম শিল্পী। তিনিই প্রথম কমা, সেমিকোলন, ছেদ ইত্যাদি যতিচিহ্ন ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় এক নতুন শব্দ বিন্যাস রীতির প্রচলন করে অনন্য কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন। তার প্রমাণ ‘শকুন্তলা’, ‘ভান্তিবিলাস’ প্রভৃতি গ্রন্থে ছড়িয়ে আছেবিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই লিখেছেন—“তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা”.
সমাজ সংস্কারঃ সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের প্রধান অবদান ‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন’। এ বিষয়ে তিনি ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ৩১শে শ্রাবণ তাঁর ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্রকে এক পত্রে লেখেন ‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।’তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ একটি যৌথ আবেদনপত্র সরকারের কাছে পেশ হয়। ফলে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই ‘বিধবা বিবাহ’ আইন ঘোষিত হয়। এই আইন পাশ হওয়ার পর এগারো বছরের মধ্যে তিনি ৬১টি বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। তৎকালীন যুগে তাঁর তাতে নিজের ৮২ হাজার টাকা খরচ হয়েছিলতিনি নিজের পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের বিবাহ এক বিধবা কন্যার সঙ্গে দিয়েছিলেন। তিনি বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেন।
চরিত্র বৈশিষ্ট্যঃ বিদ্যাসাগর ছিলেন করুণার সাগর। অতুলনীয় তাঁর সেবাপরায়ণতা। দুঃখী-দরীদ্র মানুষের সেবায় বিদ্যাসাগর ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর দানের খ্যাতি আজও বাংলার ঘরে ঘরে বিদিত। কারমাটারে দরিদ্র সবর মানুষদের সেবা করেছেন অন্ন-বস্ত্র-ওষুধ দিয়ে। নিজে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় দুঃস্থ মানুষের সেবা করেছেন আজীবন। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি তাঁর চরিত্রের বিশিষ্ট্য গুণ। তিনি যেকোনো কাজে মায়ের সম্মতি নিতেন আগে। ঋণগ্রস্থ কবি মধুসূদন বিদেশে বিপন্ন বোধ করলে তাঁকে টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করেছেন।
মহাপ্রয়াণঃ ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই এই বাঙালী মনীষীর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
উপসংহারঃ বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় ও ক্ষণজন্মা পুরুষ। বঙ্গজননীর এই কৃতী সন্তান চিরযৌবনের অভিষেক লাভ করে যেভাবে বলশালী হয়েছিলেন, তাঁর নবীনতাই আমাদের কাছে পূজনীয়। মানব প্রেমের এমন করুণাঘনমূর্তি আর মেলে না। তাই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন—
“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে
করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে—
দীন যে দীনের বন্ধু!”

--------- x ---------

আবুল পাকির জয়নাল আবেদিন আব্দুল কালাম / এ.পি.জে. আব্দুল কালাম
ভূমিকাঃ আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম ছিলেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একাদশ রাষ্ট্রপতি। কালাম তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে। পরে তিনি ঘটনাচক্রে রাজনীতিবিদে পরিণত হন। ২০০২ সালে কালাম তৎকালীন শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি ও বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। পাঁচ বছর এই পদে আসীন থাকার পর তিনি শিক্ষাবিদ, লেখক ও জনসেবকের সাধারণ জীবন বেছে নেন। ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছিলেন কালাম।
প্রথম জীবন ও শিক্ষাঃ আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির (অধুনা ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের) রামেশ্বরমের এক তামিল মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জয়নুল-আবেদিন ছিলেন একজন নৌকামালিক এবং মাতা অশিয়াম্মা ছিলেন গৃহবধূ। তাঁর পিতা রামেশ্বরম ও অধুনা-বিলুপ্ত ধনুষ্কোডির মধ্যে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নৌকায় পারাপার করাতেন। কালামের পরিবার ছিল অত্যন্ত গরিব। অল্প বয়স থেকেই পরিবারের ভরনপোষণের জন্য তাঁকে কাজ করা শুরু করতে হয়। বিদ্যালয়শিক্ষা সমাপ্ত করার পর পিতাকে সাহায্য করার জন্য তাঁকে সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করতে হয়। বিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র। কিন্তু তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠোর পরিশ্রমী ছাত্র। তাঁর শিক্ষাগ্রহণের তীব্র বাসনা ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি পড়াশোনা করতেন ও অঙ্ক কষতেন। রামনাথপুরম স্কোয়ার্টজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর কালাম তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ'স কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে সেই কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন। পাঠক্রমের শেষের দিকে তিনি পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে চার বছর ওই বিষয় অধ্যয়ন করে নষ্ট করার জন্য তিনি আক্ষেপ করতেন। ১৯৫৫ সালে তিনি মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে আসেন। এখানকার মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিথেকে তিনি বিমানপ্রযুক্তি শিক্ষা করেন। একটি সিনিয়র ক্লাস প্রোজেক্টে কাজ করার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিন তাঁর কাজে অগ্রগতি না দেখে অসন্তুষ্ট হন। তিনি ভয় দেখান তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে তাঁর বৃত্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। কালাম তিন দিনেই কাজ শেষ করেন। তা দেখে ডিন খুশি হন। পরে তিনি কালামকে লিখেছিলেন, "আমি তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলাম। তোমাকে এমন সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলেছিলাম যা করা খুব শক্ত।" তিনি অল্পের জন্য যোদ্ধা পাইলট হওয়ার সুযোগ হারান। উক্ত পরীক্ষায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর আট জন কর্মীর দরকার ছিল। তিনি পরীক্ষায় নবম হয়েছিলেন।
বিঞ্জানী হিসেবে পেশাজীবনঃ তিনি ১৯৬০ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংগঠন  (DRDO) - এর Aeronautical Development Establishment - এ একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন।উক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি একটি ছোট হোভারক্রাফট এর নকশা তৈরি করে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কালাম INCOSPAR committee - তে ড. বিক্রম সারাভাই এর অধীনে কাজ করতেন । এরপর ১৯৬৯ সালে , আব্দুল কালাম Indian Space Research Organisation (ISRO) - এ যোগদান করেন। সেখানে তিনি ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণকারী যান (SLV-III) - এর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন যা ১৯৮০ সালের জুলাইয়ে 'রোহিণী' কৃত্রিম উপগ্রহকে তার কক্ষপথে স্থাপন করে।
তিনি ১৯৬৩-৬৪ সালে নাসার  Langley Research Centre , Goddard Space Flight Centre এবং  Wallops Flight Facility পরিদর্শন করেন। তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের মাঝে  Polar Satellite Launch Vehicle (PSLV) এবং SLV-III গড়ার চেষ্টা করেন । তিনি এই কাজে সফল হয়েছিলেন।
সম্মান ও পুরস্কারঃ কালাম ১৯৮১ সালে ভারতরত্ন, ১৯৯০ সালে পদ্মবিভূষণ, ২০১২ সালে সাইমন ফ্রিসার ইউনিভারসিটি থেকে Doctor of Law, ২০১৪ সালে Edinburg University থেকে Doctor of Science আরও অসংখ্য পুরস্কার সম্মান পেয়েছেন।
মৃত্যুঃ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানে বসবাসযোগ্য পৃথিবী বিষয়ে বক্তব্য রাখার সময় ভারতীয় প্রমাণ সময় সন্ধ্যে ৬:৩০ নাগাদ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। তাঁকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সন্ধ্যে ভারতীয় প্রমাণ সময় ৭:৪৫ নাগাদ তাঁর মৃত্যু ঘটে।
কালামের মৃতদেহ ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শিলং থেকে গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানে নতুন দিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তিন বাহিনীর প্রধান কালামের মরদেহে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এরপর জাতীয় পতাকায় ঢেকে কালামের দেহ ১০, রাজাজি মার্গে তাঁর দিল্লির বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হলে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব সহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিরা শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
ভারত সরকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কালামের মৃত্যুতে তাঁর সম্মানে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, কালামের মৃত্যু দেশের বিজ্ঞান জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি, কারণ তিনি ভারতকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ও পথ দেখিয়েছিলেন। চতুর্দশ দলাই লামা কালামের মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন ও প্রার্থনা করে বলেন যে, কালাম শুধুমাত্র একজন বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদ বা রাষ্ট্রনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন নিপাট ভদ্রলোক, সরল ও বিনয়ী। ভূটান সরকার দেশের পতাকা অর্ধনমিত রাখার ও ১০০০টি বাতি প্রজ্জ্বলনের নির্দেশ দেয় এবং ভূটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে কালামকে ভারতীয় জনগণের রাষ্ট্রপতি বলে উল্লেখ করে গভীর শোক প্রকাশ করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সুসিলো বমবাং ইয়ুধোয়োনো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং কালামের প্রতি সম্মান জানান।


--------- x ---------


REJAUL HOQUE SARKAR
Writer & Editor
Follow on Twitter : www.twitter.com/edu_reja
Like us on Facebook : www.facebook.com/edureja1

আপনার লেখা নোট্‌স বা সাজেশন বা ওই জাতীয় কোনো
কিছু আমাদের Website-এ আপলোড করতে উপরের
উল্লিখিত ই-মেলে সেটি Docx/Doc ফরম্যাটে Attachment করে
আপনার নাম, ফোন নং এবং আপনার পেশা লিখে
আমাদের মেল করুন। কোনো খরচ ছাড়াই আপনার লেখা আমাদের
Website-এ আপলোড করা হবে।


অন্যান্য বিষয়ঃ-
১/
শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক (৫টি)
=>
VISIT
=>
DOWNLOAD
২/
প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক (৪টি)
=>
VISIT
=>
DOWNLOAD
৩/
বিঞ্জান ও বিঞ্জান চেতনা বিষয়ক (৪টি)
=>
VISIT
=>
DOWNLOAD
৪/
খেলাধুলা, গুণ, নীতি ও চরিত্র বিষয়ক (৩টি)
=>
VISIT
=>
DOWNLOAD
৫/
বিবিধ বিষয়ক  (১৫টি)
=>
VISIT
=>
DOWNLOAD

  • Blogger Comments
  • Facebook Comments

5 comments:

  1. ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্যজীবন সম্পর্কে ৩০০ টা শব্দের মধ্যে প্রবন্ধ রচনা

    ReplyDelete
  2. আপনার রচনা গুলি দারুণ

    ReplyDelete
  3. Amar jibaner adarsa purush ar prabanda ta dila valo hoy

    ReplyDelete

Item Reviewed: Bengali Essay Writing / বাংলা প্রবন্ধ রচনা - ১ম পর্ব Description: Rating: 5 Reviewed By: Rejaul Hoque Sarkar
Scroll to Top